বাঙালির প্রায় প্রত্যেক বাড়িতেই প্রতিবছর কোজাগরী লক্ষ্মীপুজো করা হয়। আড়ম্বর হোক বা ঘরোয়া উপাচারে, মায়ের আরাধনার রীতি তথা Laxmi Puja Rituals বছরের পর বছর ধরে চলে আসছে। আশ্বিন মাসের শুক্লা পক্ষের প্রথমা থেকে শুরু হয় মহালয়া, আর ষষ্ঠী থেকে দশমীর দুর্গা বন্ধনা। এর পরই প্রতি বছর আশ্বিন মাসের পূর্ণিমা তিথিতে লক্ষ্মী পুজো করা হয়। মা লক্ষ্মী ধন ও ঐশ্বর্যয়ের দেবী। তাই বাড়ির মা মাসিরা প্রতি বৃহস্পতিবার ভক্তিভরে যেমন লক্ষ্মীর পাঁচালি পড়েন, ঠিক তেমনি আশ্বিন মাসে কোজাগরী লক্ষ্মীপুজোও করে থাকেন।
Kojagori Laxmi Puja Rituals at home
প্রায় প্রত্যেক বাড়িতে লক্ষ্মী পূজা হয়, তাই অনেক সময় পুরোহিত পাওয়া যায় না। অথবা অনেকে নিজেই বাড়িতে বসে ভক্তিভরে পূজা করতে চান। তাদের জন্য বাড়িতে বসে পুরোহিত ছাড়া লক্ষ্মী পূজা করার সঠিক শাস্ত্রীয় পদ্ধতি (Laxmi Puja Rituals), ধাপে ধাপে দেওয়া হলো। এই প্রতিবেদনে, পুজোর আগে কি কি করতে হবে, পুজোর সময় ও পুজোর পর কি কি করতে হবে সমস্ত কিছু আলোচনা করা হলো। অন্যদের প্রতিবেদনটি শেয়ার করবেন।
পুরোহিত ছাড়া লক্ষ্মী পূজা করার নিয়ম
কোজাগরী লক্ষ্মীপূজা বাঙালির ঘরে ঘরে সমৃদ্ধি ও সুখের প্রতীক। এই পূজায় মা লক্ষ্মীকে আহ্বান করে পরিবারের মঙ্গল কামনা করা হয়। বাড়িতে নিজের হাতে পূজা করার আমেজই আলাদা। সম্পূর্ণ শাস্ত্রীয় নিয়ম মেনে পুরোহিত ছাড়া লক্ষ্মী পুজো (Laxmi Puja Rituals without Brahmin) করতে হলে নিচে ধাপে ধাপে এই পূজার প্রত্যেকটি নিয়ম পালন করতে হবে। এখানে সহজ মন্ত্র গুলো উল্লেখ করা হয়েছে, যাতে সহজেই উচ্চারন করা যায় এবং উপাচার গুলো ও যথা সম্ভব সহজ রাখা হয়েছে।
ধাপ ১: পবিত্রতার প্রস্তুতি
পূজার শুরুতে (Laxmi Puja Rituals) পবিত্রতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। পূজার বেদী এবং আপনার আসনের চারপাশে তিনবার ‘গঙ্গা’ নাম উচ্চারণ করে গঙ্গাজল ছিটিয়ে দিন। এরপর হাতে গঙ্গাজল নিয়ে এই মন্ত্রটি পড়ুন:
‘অপবিত্রঃ পবিত্রোবা সর্ব্বাবস্থাং গতোহপি বা। যঃ স্মরেৎ পুণ্ডরীকাক্ষ স বাহ্যভ্যন্তর শুচিঃ।।’
এর পর তিনবার ছেলে হলে ‘ওম বিষ্ণু’ মেয়ে হলে ‘নমঃ বিষ্ণু’ বলে ভগবান নারায়ণকে স্মরণ করুন। এই প্রক্রিয়া আপনার মন ও পরিবেশকে শুদ্ধ করবে। এখন পূজার জন্য প্রস্তুতি সম্পন্ন।
ধাপ ২: পূজার স্থান সাজানো
পূজার স্থান প্রস্তুত করতে একটি তামার পাত্রে জল রাখুন, যাকে কোষাকুষি বলা হয়। এর পাশে আরেকটি তামার পাত্র স্থাপন করুন। এই পাত্রে জল, জবা ফুল, দূর্বা এবং আতপ চাল মিশিয়ে সূর্যদেবকে জল অর্পণ করুন। এই অর্পণ মা লক্ষ্মীর পূজার জন্য পরিবেশকে আরও পবিত্র করে। ধীরে ধীরে জল ঢালুন এবং মনে মনে সূর্যদেব কে স্মরণ করুন এবং তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করুন।
ধাপ ৩: ঘট স্থাপন ও সাজানো
এবার একটি মাটির গোল মণ্ড তৈরি করুন এবং তার উপর ঘট স্থাপন করুন। মাটির মণ্ড না থাকলে ঘট স্থাপনের জন্য সুবিধাজনক কিছু ব্যবহার করতে পারেন। ঘটের সামনে কিছু ধান ছড়িয়ে দিন এবং সিঁদুর দিয়ে একটি স্বস্তিক চিহ্ন আঁকুন। ঘটে জল ভরে কয়েক ফোঁটা গঙ্গা জল দিন এবং ঘটের উপর একটি বেজোড় সংখ্যক পাতার আম্রপল্লব রাখুন। পাতার উপর হরিতকী, ফুল এবং দূর্বা স্থাপন করুন। এরপর আম্রপল্লবে তেল ও সিঁদুরের ফোঁটা দিয়ে একটি শীষসহ ডাব রাখুন। এই প্রক্রিয়া ঘটকে পূজার জন্য প্রস্তুত করে এবং মা লক্ষ্মীকে আহবান জানায়।
ব্রাহ্মণ ছাড়া লক্ষ্মী পুজো
ধাপ ৪: মা লক্ষ্মীকে আহ্বান
এখন মা লক্ষ্মীকে ডাকার পালা। হাত জোড় করে আন্তরিকভাবে বলুন:
“ওঁ লক্ষ্মীদেবী ইহাগচ্ছ ইহাগচ্ছ
ইই তিষ্ঠ ইহ তিষ্ঠ
ইহ সন্নিধেহি ইহ সন্নিরুদ্ধস্য
অত্রাধিষ্ঠান কুরু মম পূজান গৃহাণ।”
এই মন্ত্রটি কঠিন মনে হলে, বা উচ্চারন করতে সমস্যা হলে, বাংলায় নিচের কথা গুলো বলুন। কিন্তু কোনও অবস্থাতেই ভুল মন্ত্র উচ্চারন করবেন না।
‘মা আমার গৃহে তোমার আগমন হোক, আমার গৃহে অধিষ্ঠান করো তুমি, নৈবেদ্যস্বরূপ আমার এই সামান্য আয়োজন গ্রহণ করো।’
এই আহ্বানে আপনার ভক্তি ও নিষ্ঠা প্রকাশ পায়। মা লক্ষ্মীকে আপনার ঘরে স্বাগত জানানোর এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ ধাপ। মনে রাখবেন, সংস্কৃত মন্ত্র নয়, আপনার হৃদয়ের ভক্তিই মূল মাকে প্রসন্ন করার মূল উপায়।
ধাপ ৫: প্রণাম মন্ত্র ও নৈবেদ্য অর্পণ
মা লক্ষ্মীর প্রণাম মন্ত্র পড়ে তাঁকে সম্মান জানান। মন্ত্রটি হলো:
‘ওঁ বিশ্বরূপস্য ভার্যাসি পদ্মে পদ্মালয়ে শুভে। সর্ব্বত পাহি মাং দেবি মহালক্ষ্মী নমস্তুতে।।’
এটি ও উচ্চারন করতে সমস্যা হলে মনে মনে বলুন, আমি নিয়ম বিধি জানিনা, আমার পুজো গ্রহণ করো মা, এই বলে প্রণাম করুন।
এরপর গান বা মন্ত্রের মাধ্যমে মা লক্ষ্মীকে আহ্বান করুন। প্রতিটি নৈবেদ্যে ফুল এবং বেলপাতা দিয়ে মাকে নিবেদন করুন। এই ধাপে আপনার প্রতিটি উপহার মা লক্ষ্মীর প্রতি ভালোবাসার প্রতীক। নৈবেদ্য অর্পণের সময় মনোযোগ ধরে রাখুন।
ধাপ ৬: পুষ্পাঞ্জলি ও পাঁচালি পাঠ
পুষ্পাঞ্জলি দেওয়ার জন্য নিচের মন্ত্রটি পড়ে তিনবার মা লক্ষ্মীর চরণে ফুল অর্পণ করুন:
‘ওঁ নমস্তে সর্ব্বদেবানাং বরদাসি হরিপ্রিয়ে। যা গতিস্তৎ প্রপন্নানাং সা মে ভুয়াত্তদর্চনাৎ। এষ সগন্ধ পুষ্প বিল্বপত্রাঞ্জলি শ্রীং লক্ষ্মীদেব্যৈ নমঃ।।’
অঞ্জলি দেওয়ার পর হাতে দূর্বা ও ফুল নিয়ে লক্ষ্মীর পাঁচালি পাঠ করুন। পাঁচালি পড়া শেষ হলে তিনবার শঙ্খধ্বনি দিন। এরপর ষাষ্টাঙ্গে প্রণাম করে পূজা সমাপ্ত করুন। এই ধাপ পূজার শেষ এবং আপনার ভক্তির পরিপূর্ণতা প্রকাশ করে (Laxmi Puja Rituals).
উপসংহার: মা লক্ষ্মীর কৃপায় সমৃদ্ধি
কোজাগরী লক্ষ্মীপূজা আপনার ঘরে শান্তি ও সমৃদ্ধি নিয়ে আসে। এই সহজ ধাপগুলো অনুসরণ করে আপনি ব্রাহ্মণ ছাড়া লক্ষ্মী পুজো বা পুরোহিত ছাড়া লক্ষ্মী পূজা সম্পন্ন করতে পারেন। প্রতিটি ধাপে আপনার ভক্তি ও নিষ্ঠাই মূল চাবিকাঠি। মা লক্ষ্মীকে ডেকে আপনার পরিবারের মঙ্গল কামনা করুন। এই পূজা আপনার ঘরে সুখ ও ঐশ্বর্যের আলো জ্বালাবে। শুরু করুন আজই এই পবিত্র যাত্রা।
আরও পড়ুন, ঘরের লাইট জ্বালালেই শ্যামা পোকার উপদ্রব? জেনে নিন শ্যামা পোকা তাড়ানোর উপায়।