বহু প্রতীক্ষিত লোকসভা ভোটের রেজাল্ট বেরিয়েছে কাল। প্রায় দেড় মাস ধরে চলেছে ভোট পর্ব। রাজ্যজুড়ে মোট ৪২ টি কেন্দ্রে ভোট গ্রহণ করা হয় সাত দফায়। এ বছরের নির্বাচন নিয়ে একটু বেশিই উন্মাদনা ছিল রাজনৈতিক দলগুলির মধ্যে। বিশেষ করে গেরুয়া শিবিরের এবারে প্রধান লক্ষ্য ছিল পশ্চিমবঙ্গ। কিন্তু ভোটের রেজাল্টের পর ফের পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূল রাজ প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় স্বপ্ন ভাঙলো বিজেপির। প্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর এত প্রচার, তৃণমূলের বিভিন্ন দুর্নীতির পর্দা ফাঁস করা, তারপরেও কেন এই পরাজয়, এর উত্তর খোঁজার চেষ্টা করছেন অনেকেই। আর সারা দেশে গেরুয়া ঝড়ের মধ্যে তৃণমূলের ২২ থেকে ২৯ হওয়ার সাফল্যের কারন ও বিজেপির ধরাশায়ী হওয়ার ১০টি কারন নিয়ে এই প্রতিবেদন।
একনজরে রাজ্যের ভোটের ফলাফল
পশ্চিমবঙ্গের ৪২টি আসনের মধ্যে তৃণমূল পেয়েছে ২৯টি আসন, বিজেপি পেয়েছে ১২টি আসন, এবং কংগ্রেস পেয়েছে ১টি আসন। ২০১৯ সালে তৃণমূল পেয়েছিলো ৪৪% ভোট, আর এবার পেয়েছে ৪৬% ভোট। পশ্চিমবঙ্গের ফলাফলের মধ্যে নজরকাড়া কয়েকটি বিষয় হলোঃ
- সন্দেশখালী ইস্যু নিয়ে সারা রাজ্যে যেভাবে প্রচারের ঝড় তুলেছিলো বিজেপি। সেই কেন্দ্রেই কার্যত ব্যুমেরাং হয়ে কয়েক লক্ষ ভোটে হেরেছে রেখা পাত্র।
- অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় সারা দেশের মধ্যে হয়তো সর্বাধিক ব্যবধান তথা ৭ লক্ষ ভোটের ব্যাবধানে জিতেছেন।
- এবারের ভোটে বাম কার্যত শূন্য হাতে ফিরেছে।
- বাংলার বিজেপি উত্থানের পেছনে যার ভূমিকা অন্যতম, সেই দিলীপ ঘোষ পরাজিত।
- গত ৪ বারের সাংসদ অধীর চৌধুরী পরাজিত।
তৃণমূলের জয়ের প্রধান কারণ
রাজ্যের সবুজ শিবিরের জয় এর পেছনে বিশেষজ্ঞরা অনেকগুলি কারণ কে এগিয়ে রেখেছেন। এর মধ্যে প্রথমেই বলা যেতে পারে মুখ্যমন্ত্রীর সবচেয়ে জনপ্রিয় প্রকল্প লক্ষ্মীর ভান্ডারের কথা। ২০২১ এর বিধানসভার ভোটে জয়ী হয়েই তিনি এই প্রকল্প চালু করেন। যার মাধ্যমে মা-বোনেদের ৫০০ এবং ১০০০ টাকা করে দেওয়া হতো এতদিন। কিন্তু চলতি বছরের বাজেটের ঘোষণা মত মে মাস থেকেই সেই টাকা পরিমাণ বাড়িয়ে ১০০০ এবং ১২০০ টাকা করেছে রাজ্য সরকার। যা তাদের জয়ের পক্ষে একটি বড়সড়ো অবদান রেখেছে।
লক্ষ্মীর ভান্ডার ছাড়াও রাজ্যের প্রায় ১২টি প্রকল্প রয়েছে যেগুলোতে সরাসরি সাধারণ মানুষ আর্থিকভাবে উপকৃত হয়েছেন। যেখানে এর আগে এই ধরনের প্রকল্প বা সাধারণ মানুষের হাতে তেমন কিছু, সরকার সরাসরি তুলে দেয়নি, সেখানে এই ধরনের একাধিক প্রকল্প ও দুয়ারে সরকার পরিসেবা সাধারণ মানুষ কে ভরসার যায়গা এনে দিয়েছে। যেখানে দুর্নীতি বা CBI, ED প্রভৃতি ইস্যু ফিকে হয়ে গিয়েছে।
এছাড়া বিরোধীরা যে ইস্যুতে তৃণমূল কে আক্রমন করেছে, সেটার পাল্টা বা ড্যামেজ কন্ট্রোল তৃণমূল খুবই সহজেই প্রতিহত করতে পেরেছে। যেমন সন্দেশখালীর পাল্টা ভিডিও। CAA, NRC এর বিরোধী হাওয়া তৈরী করা। টেট মামলায় সুপ্রীম কোর্টের স্থগিতাদেশ আদায় করা। এছাড়া বছরের পর বছর মন্ত্রীরা ঘ্রেপ্তার থেকেও তাদের বিরুদ্ধে CBI তথ্য প্রমান জোগাড় করে দোষী সাব্যস্ত করে মামলা শেষ করতে না পারা, প্রভৃতি কার্যত দুর্নীতি প্রমানিত প্রতিষ্ঠিত হতে পারেনি।
অন্যদিকে, বহুদিন ধরে ডিএ পাওয়ার অপেক্ষায় ছিলেন রাজ্য সরকারি কর্মচারীরা। এই নিয়ে তারা অনেক বিরোধিতাও করেছেন রাজ্য সরকারের। কিন্তু নিজের কথা রেখে রাজ্য সরকার এবছর ডিসেম্বরে ৪ শতাংশ, আর বাজেটে আরো ৪ শতাংশ ডিএ মেটানোর ঘোষণা করায় সেটা রাজ্য সরকারি কর্মচারীদের ওপর বড়সড় প্রভাব ফেলেছে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। এই কারণটিও অনেকেই না মানলেও, পোস্টাল ব্যালেটের রেজাল্ট তার ইঙ্গিত দেয়। ২০১৯ ও ২০২১ এর ভোটে বিজেপি পোস্টাল ব্যালেটে ৮০% আসন পেলেও এবারে পেয়েছে মাত্র ৪৫% আসন।
পশ্চিমবঙ্গে বিজেপির ব্যর্থতার কারণ
১) ২০১৯ এর সাফল্যের পরও দিলীপ ঘোষ কে সভাপতির পদ ও রাজ্যের মূল চালকের আসন থেকে সরিয়ে শুভেন্দ্যু ও সুকান্ত নির্ভর হয়ে পড়া এবং শেষ মুহুর্তে দিলীপ ঘোষকে মেদিনীপুর থেকে সরিয়ে দুর্গাপুর নেওয়া শুধু তার আসনই নয়, বরং সাংগঠনিক দিক দিয়ে অনেক ভুল সিদ্ধান্ত হতে পারে। পর্যবেক্ষকেরা বলছেন, দিলীপ ঘোষ কে সেন্সর না করলে কর্মীদের চাঙ্গা রাখা ও সংগঠনে আরও শৃঙ্খলা ফেরানোর কাজটা তিনি আরও ভালো করতেন।
আরও পড়ুন, ভোট মিটতেই বিনামূল্যে রেশন বন্ধ হলো। বহু রেশন কার্ড বাতিল।
২) রাজ্যের টাকা বঞ্চনা করেছে কেন্দ্র। যখন এই ইস্যুতে রাজ্য সরকার সরব, ঠিক কি কারনে টাকা পাচ্ছেন না জনগন, সেই উত্তর প্রতিষ্ঠিত করতে না পারা। এখানে ভুললে চলবে না, রাজ্য দুর্নীতি করুক আর নাই করুন, জনগনের প্রাপ্য টাকা না পেলে তাদের মধ্যে অসন্তোষ সৃষ্টি হবেই। কেন্দ্র সরকার তো সরাসরি তাদের একাউন্টে বকেয়া টাকা দিতেই পারতো। কিম্বা আইন অনুযায়ী বিকল্প কোনও ব্যাবস্থা করতেই পারতো। লোকে ১০০ দিনের কাজ না করে টাকা না পেলে তো রাগবেই। আর সেখানে রাজ্য সরকার ১০০০ টাকা অনুদান দিলে অভাবী মানুষদের সেটা সাপোর্ট তো আসবেই।
৩) সন্দেশখালী ইস্যু নির্বাচনের আগে যেখানে বিজেপি কে বাড়তি মাইলেজ দিয়েছিলো, সেখানে যখন ভিডিও ভাইরাল হলো, বিজেপি তখন ড্যামেজ কন্ট্রোল করতে পারেনি। এছাড়া রাজ্য সরকার যখন কেন্দ্রের বিভিন্ন ইস্যু নিয়ে গলা ফাটিয়েছে, সেগুলোকে প্রতিউত্তর বা লোকের মনে বিশ্বাস যোগানোর মতো তেমন বিশ্বাস প্রতিষ্ঠিত করতে পারেনি। এছাড়া ভোটের আগের দিন ও সন্দেশখালীতে কর্মীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারেনি বিজেপি।
৪) প্রার্থী বাছাইয়ে দেরি করা ও ৫টি আসনে ভুল প্রার্থী বাছাই করা, বিজেপির আরও ৫টি জেতা আসন হাতছাড়া হয়েছে।
৫) পশ্চিমবঙ্গে শিক্ষক নিয়োগ থেকে চিটফান্ড ও বিভিন্ন দুর্নীতির মামলা দিনের পর দিন চলেছে। ভোটের মুখে দুর্নীতি নিয়ে যখন বছরের পর মামলা চলেছে, সেখানে দ্রুত শুনানি করে বা বিচার করে দোষী সাব্যস্ত করতে পারেনি। যার ফলে এই মামলা বড় একঘেয়ে লেগেছে সাধারণ মানুষের কাছে। এছাড়া CBI, ED এর তদন্ত অনন্তকাল চলতে পারেনা, এই মন্তব্য খোদ আদালতের অন্দর থেকেও উঠে এসেছে।
আরও পড়ুন, BJP জিতেই এই শেয়ার গুলো লাফিয়ে উঠবে।
৬) এছাড়া বিজেপিতে এলে সবাই সাদা হয়ে যাবে, এই দাবী তৃণমূল বার বার করেছে, যেখানে সাধারণ মানুষের ও তেমনটাই মনে হয়েছে। আর তৃণমূল এইকথা যতবার বলেছে, বিজেপি নিরব থেকেছে।
৭) যারা বছরের পর বছর মার খেয়ে, সংগঠনটাকে দাড় করিয়েছে বা টিকিয়ে রেখেছে, তাদের নেতাকে প্রার্থী না করায় কর্মীদের একাংশের মধ্যেও কিছুটা আক্ষেপের সৃষ্টি হয়েছে। এছাড়া রাজ্য নেতৃত্ব ও স্থানীয় নেতৃত্বের কম্যুনিকেশনে যথেষ্ট গ্যাপের সৃষ্টি হয়।
৬) এদিকে বিজেপি পক্ষ বারবার চেষ্টা করে গেছে তৃণমূলকে সরিয়ে নিজেদের শাখা বিস্তারের। সন্দেশখালি কান্ডে, শিক্ষক নিয়োগের দুর্নীতিতে, এমনকি আবাস যোজনার টাকা তছরুপিতেও নাম জড়িয়ে তারা সম্মান খর্ব করার চেষ্টা করেছে তৃণমূল পক্ষের। কিন্তু তাতে মানুষের ক্ষোভ তৈরি হয়নি। উল্টে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথাই মানুষ বিশ্বাস করেছে।
৯) অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাস ও এই পরাজয়ের ক্ষেত্রে একটি কারণ। বিজেপির গঠনমুলক, চাকরির প্রতিশ্রুতি ও ঘরে ঘরে কাজ, দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি এই ধরনের এজেন্ডা এবারে বেশি জোর দেওয়া উচিত ছিলো।
বিজেপি সংখ্যাগরিস্টতা পেলেও ইতিমধ্যেই নিয়ম অনুযায়ী মাননীয় রাষ্ট্রপতির কাছে পদত্যাগ করলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। আগামী ৮ই জুন শনিবার সন্ধ্যায় তৃতীয়বারের জন্য প্রধানমন্ত্রী হিসাবে শপথ নেবেন। আপডেট আসছে।
ঘাসফুল শিবিরের এই খেলা ঘুরিয়ে দেওয়া জয় দেখে বিশেষজ্ঞদের অনেকে বলেছেন, “যেটা মনে করা হচ্ছিল সেটা হয়নি। বুথের সমীক্ষা আর মানুষের মত অন্য কথা বলেছে। আগামী ২০২৬ সালে রয়েছে রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচন। তবে বর্তমানের পরিস্থিতি দেখে আশা করা যাচ্ছে না যে তৃণমূলকে হারিয়ে বিজেপি আসবে এরাজ্যে।” যদিও রাজনীতির হাওয়া কখন কোনদিকে বয়ে চলে বোঝা বড় দায়। এই বিষয়ে আপনার কি মনে হয়, নিচে কমেন্ট করবেন।
Written by Nabadip Saha.